বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০৮:৪৯ অপরাহ্ন

নোয়াখালীতে আ.লীগের রাজনীতি কোন পথে

নোয়াখালীতে আ.লীগের রাজনীতি কোন পথে

স্বদেশ ডেস্ক:

দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে মাস তিনেক আগে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। অভিযোগের সূত্র ধরে নরসিংদী, সিরাজগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলা ও উপজেলার হেবিওয়েট নেতাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় দলটি। কেন্দ্রের এমন কঠোর সিদ্ধান্তে দীর্ঘদিন ধরে অন্তর্কোন্দলে লিপ্ত দেশের নানা প্রান্তের নেতারা পুরোপুরি দমে না গেলেও অন্তত নড়েচড়ে বসেন। কিন্তু উল্টো চিত্র নোয়াখালীতে। বিরামহীন দলীয় কোন্দল বিরাজ করছে সেখানে।

জেলায় গত দুই মাসে সাংবাদিকসহ দুজন খুন ও দলের শতাধিক নেতাকর্মীর আহতের ঘটনা ঘটলেও কারও কিছু হচ্ছে না। বরং বীরদর্পে একে অন্যকে দোষারোপ করে বাহাস চালিয়ে যাচ্ছেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী এমপি ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র মির্জা আবদুল কাদের।

এরই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার বসুরহাটের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই মির্জা কাদেরের সমর্থকদের হামলা-পাল্টাহামলায় একজন নিহত হন। পুলিশসহ আহত হন অর্ধশতাধিক। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বসুরহাট পৌরসভায় গতকাল বুধবার ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। ফলে সারা দিনই বসুরহাট এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। ভয়ে-শঙ্কায় ঘর থেকে বের হননি সাধারণ মানুষ।

আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় মানুষের এই শঙ্কা কাটবে কবে? নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী এমপি ও মির্জা আবদুল কাদেরকে থামাবে কে? এই প্রশ্ন এখন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরও। কিন্তু এই প্রশ্নের সদুত্তর দিচ্ছেন না কেউ। এ বিষয়ে আমাদের সময় থেকে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে নোয়াখালী তথা চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের কোনো নেতা কথা বলতে রাজি হননি।

নোয়াখালী জেলা-উপজেলার বিতর্কিত নেতাদের কী হবে এ বিষয়ে কিছু না বললেও গত মঙ্গলবার কোম্পানীগঞ্জের হতাহতের ঘটনায় কাউকে ছাড় নয়- এমন মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি গতকাল বিকালে তার বাসা থেকে ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। বিশৃঙ্খলার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের পরিচয় না দেখে আইনের আওতায় আনা হবে।

ওই ঘটনাকে অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইজিপি, র‌্যাবের ডিজি, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি ও জেলা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা হয়েছে। আইন সমানভাবে প্রযোজ্য। ইতোমধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অভিযান চলছে।

তিনি আরও বলেন, এ দুঃখজনক ঘটনার তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট এলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।

তিনি বলেন, বেশ কিছু দিন থেকে কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট এলাকায় জনজীবনে অস্থিরতা বিরাজ করছিল, সরকার এখন কঠোরভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করছে। তাই আশা করা হচ্ছে শিগগিরই জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে। ওবায়দুল কাদের কোম্পানীগঞ্জের জনগণকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ধৈর্য ধারণ এবং সরকারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

শুধু নোয়াখালী নয়, সামগ্রিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য আবদুর রহমান গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, দলের শৃঙ্খলা রক্ষা আমাদের সাংগঠনিক কাজের অংশ। সারাদেশের নেতৃবৃন্দকেই আমরা বলে থাকি- দলের ইমেজ নষ্ট হয় এমন কাজ করা যাবে না, দলের প্রতি আনুগত্যশীল হতে হবে। নেতাকর্মীদের প্রতি নেত্রী শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা রয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। যদি কেউ এর ব্যত্যয় ঘটায়, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা আমাদের সময়কে বলেন, ব্যবসায়িক কারণে একরামুল করিমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দলের বেশ কজন প্রভাবশালী নেতার সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে ভীতি তৈরি করে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগে দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন একরাম। অন্যদিকে মির্জা কাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। সব মিলিয়ে কেন্দ্রের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দেখেশুনেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের ও তার স্ত্রী ইশরাতুন্নেছার বিরুদ্ধেও বক্তব্য দিচ্ছেন মির্জা কাদের। এ কারণে ওবায়দুল কাদের নিজেও বিব্রত। ফলে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ ছাড়া নোয়াখালীতে শান্তি ফিরে আসবে বলে মনে হচ্ছে না- মন্তব্য ওই প্রবীণ নেতার।

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালের পর থেকে নোয়াখালী আওয়ামী লীগে কোন্দল বিরাজ করছে। অভিযোগ রয়েছে- দলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়া, অন্য দলের নেতাদের দলে আশ্রয় দেওয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একরামুল করিম চৌধুরী। এ নিয়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ বাধে। হয়েছে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনাও। যদিও এসব ঘটনাকে বিগত দিনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দায় এড়িয়েছেন।

গত ৩১ ডিসেম্বর বসুরহাট পৌরসভার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণাকালে মির্জা কাদের আওয়ামী লীগ নিয়ে তুমুল সমালোচনামূলক বক্তব্য দেন। বক্তব্যটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে আলোচনার ঝড় ওঠে। তার সেই বক্তব্যের সারসংক্ষেপ ছিল- সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে দু-তিনজন ছাড়া আওয়ামী লীগের এমপিরা পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না। তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনেরও দাবি তোলেন। এর পর ধারাবাহিকভাবে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী এমপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পদবাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরেন তিনি। অভিযোগ তোলেন একরামুল করিমের ছেলে সাবাব চৌধুরীর বিরুদ্ধেও। সাবাবের নেতৃত্বে গড়া আংকেল বাহিনীর মাধ্যমে ‘আওয়ামী লীগ নিধনে’র অভিযোগও করেন মির্জা কাদের।

বসুরহাট পৌর মেয়র মির্জা কাদেরের সূত্র ধরে ফের দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ। মির্জা কাদের ও ওবায়দুল কাদেরেকে একরামুল করিম রাজাকার পরিবারের সদস্য বলায় জেলাটিতে ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। এর প্রতিবাদে নোয়াখালী ও ঢাকাতে মানববন্ধনের প্রস্তুতি নিতে গেলে ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে তা স্থগিত করা হয়। পরে টিভির অনুষ্ঠানে এসে এই বক্তব্যের জন্য ওবায়দুল কাদেরের কাছে ক্ষমা চান একরাম। কিন্তু মির্জা কাদেরকে নিয়ে করা বিরূপ মন্তব্য অব্যাহত রাখেন। ওই টিভি প্রোগ্রামেও তাকে পাগল সম্বোধন করেন। এই বক্তব্যে আরও ক্ষিপ্ত হন মির্জা কাদের। তিনি একরামকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতিসহ শাস্তি দাবি করে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যান। স্থানীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবেও তিনি সংবাদ সম্মেলন করে একরামুল করিমের বিচার দাবি করেন। মির্জা কাদেরের সব বক্তব্যের জবাব একরাম দেন ফেসবুক লাইভে এসে। এভাবেই স্থানীয় নেতা হয়েও জাতীয় রাজনীতির আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছেন এই দুই নেতা। কথায় কথায় তারা দুজনেই নিজেদের আওয়ামী লীগ সভাপতির লোক বলে দাবি করেন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, আমরা কেউ দলের ঊর্ধ্বে নই, প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে নই। এই সত্য আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীর জন্য সত্য। কেউ যদি এর ব্যত্যয় ঘটায়, তবে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক রীতি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877